♦♦ অনিদ্রা, নিদ্রাহীনতা - Insomnia, Sleeplessness
আধুনিক যন্ত্রসভ্যতা মানুষের জীবনযাত্রাকে করেছে ভয়ঙ্কর জটিল আর এই জটিলতা কেড়ে নিয়েছে তার আরামের ঘুম। অনিদ্রা মানে কম সময় ঘুমানো নয় : বরং অনিদ্রা মানে হলো ঘুমিয়ে তৃপ্তি না পাওয়া, ক্লান্তি দূর না হওয়া, দেহ-মনে সতেজ ভাব না আসা। নিদ্রাহীনতা নিয়ে
একেক জনের অভিযোগ একেক রকম। কারো ঘুমই আসতে চায় না, কেউ ঘুমিয়ে তৃপ্তি পান না, কারো ঘুম আসতে আসতে অনেক রাত হয়ে যায়, কারো ঘুম খুব ভোরে ভেঙ্গে যায়, কারো ঘুম একটু পরপরই ভেঙ্গে যায় ইত্যাদি।এই অনিদ্রা রোগ বা নিদ্রাহীনতার হাত থেকে বাচাঁর
জন্য মানুষ বোতলের পর বোতল ঘুমের ট্যাবলেট সাবাড় করছে : তাতে প্রথমে কিছুদিন ঘুম হলেও পরে আর ঘুমের ট্যাবলেটেও কোন কাজ হয় না। অথচ আমাদের অনেকেই জানি না, নিদ্রাহীনতার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা আছে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে এবং অধিকাংশ
ক্ষেত্রে এক ডোজ হোমিও ঔষধেই নিদ্রাহীনতা স্থায়ীভাবে সারিয়ে তোলা যায়।নিদ্রাহীনতা সাধারণত ৩ ধরণের হয়ে থাকে। যথা- সাময়িক (Transient), সবিরাম বা কিছুদিন পরপর দেখা দেওয়া (Interrmittent) এবং স্থায়ী বা দীর্ঘ স্থায়ী (Chronic)। অনিদ্রা
যদিও নারী-পুরুষ উভয়েরই হতে পারে : তথাপি এটি মহিলাদের মধ্যে বেশী হতে দেখা যায়। অনিদ্রার প্রধান প্রধান কারণগুলোর মধ্যে আছে মানসিক চাপ/দুশ্চিন্তা (Stress), উৎকণ্ঠা (anxiety), বিষন্নতা (depression), ভীতি (phobia), মানসিক
ভারসাম্যহীনতা (schizophrenia), ঘুমের টাইম উলটপালট করা (Reversal of sleep rhythm), বাতের ব্যথা (arthritis), উচ্চ রক্তচাপ (high blood pressure), হৃদরোগ (heart disease), হাঁপানি (asthma)
, এলার্জি (allergies), থাইরয়েড হরমোনের ক্রটি (hyperthyroidism/hyperthyroidism), পারকিনসন্স ডিজিজ (Parkinson’s disease), মাথায় আঘাত পাওয়া (head injury), গভর্ধারণ (pregnancy), মাদকাসক্তি
(addiction), ঘুম-বিষন্নতার ঔষধের অতিরিক্ত সেবন (Drugs withdrawals) ইত্যাদি ইত্যাদি। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের নিদ্রা যাওয়ার ক্ষমতা কমতে থাকে। কিন্তু কেন ? হয়ত আল্লাহর ইচ্ছা, বয়স্ক ব্যক্তিরা জীবনের শেষ পযায়ে এসে রাত জেগে ইবাদত-
বন্দেগী করে করে তাদের স্রষ্টার নৈকট্য অজর্ন করতে যাতে কোন কষ্ট না হয়।
অনিদ্রা রোগের বংশগত সম্পর্ক আছে : তার মানে পিতা-মাতার অনিদ্রা রোগ থাকলে সন্তানদেরও অনিদ্রা রোগের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সাধারণত নিদ্রাহীনতার কারণে ক্লান্তি, দুবর্লতা,
কোন কাজে মনোযোগ দিতে না পারা, খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে। সাময়িক নিদ্রাহীনতা (Transient insomnia) ঔষধ ছাড়াই কেবল জীবনধারায় (lifestyle) কিছুটা পরিবর্তন আনার মাধ্যমে দূর করা যায়। কিন্তু স্থায়ী বা দীর্ঘ স্থায়ী
(Chronic) নিদ্রাহীনতা সারিয়ে তোলতে প্রথমে তার জন্য দায়ী শারীরিক-মানসিক রোগটিকে (underlying causes) চিকিৎসার মাধ্যমে দূর করতে হবে।বহুল প্রচলিত এলোপ্যাথিক ঘুমের ট্যাবলেটগুলোতে ক্রনিক অনিদ্রা রোগের চিকিৎসায় তেমন কোন
উপকার করে না। বরং এগুলো কেহ দীর্ঘদিন খেলে তার প্রতি নেশা (dependency) হয়ে যায়। তাছাড়া এই ঔষধগুলো আমাদের বিবেক, বিচারক্ষমতা, স্মরণশক্তি, বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদির সমূহ ক্ষতি করে থাকে। আর গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা নিয়মিত এসব ঘুমের ট্যাবলেট
খান, তাদের অকাল মৃত্যুর হার অন্যদের চাইতে বেশী। ঘুমের ট্যাবলেটের প্রতিক্রিয়ায় দিনের বেলায় কাজ-কর্ম, ইবাদত-বন্দেগী, গাড়িচালানো, হাঁটার সময় ব্যালেন্স রক্ষা করা ইত্যাদি কাজ করতে অনেক অসুবিধা হয় কিন্তু হোমিওপ্যাথিক ঘুমের ঔষধগুলোতে এসব সমস্যা নাই।
অনেকে একসাথে অনেকগুলো ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যা করে বসে কিন্তু হোমিওপ্যাথিক ঘুমের ঔষধগুলো কেউ একসাথে অনেক পরিমাণে খেলেও মৃত্যুর সম্ভাবনা নাই। Nux Vomica; রাতে বিছানায় যাওয়ার পরে সারাদিনের কাজ-কর্মের চিন্তা মাথার ভিতরে কিলবিল
করতে থাকে : ফলে ঘুম আসতে চায় না। বিশেষত যারা বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য সেবন করে, বেশী বেশী চা-কফি পান করেন, যাদের পেটের অসুখ বেশী হয়, নাক্স তাদের অনিদ্রায় ভালো কাজ করে থাকে। Opium : ঘুমঘুম ভাব কিন্তু ঘুম আসে না। খুবই সেনসিটিভ, ঘড়ির
কাটার শব্দ কিংবা দূরের কোন মোরগের ডাকেও তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। দুঃস্বপ্ন দেখে, কুকুর, বিড়াল, প্রেতাত্মা, বোবায়ধরা স্বপ্নে দেখে, ঘুমের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসে ইত্যাদি লক্ষণ থাকলে অপিয়াম ঔষধটি খেতে হবে। Kali Phosphoricum : ক্যালি ফস অনিদ্রার একটি
সেরা ঔষধ। বিভিন্ন কঠিন রোগ ভোগ, অত্যধিক শারীরিক- মানসিক পরিশ্রম, অপুষ্টি, দীর্ঘদিন যাবত স্তন্যদান করা ইত্যাদির মাধ্যমে সৃষ্ট নিদ্রাহীনতায় (বা অন্যকোন রোগে) ক্যালি ফস খেতে হয়।
মাঝে মাঝে সপ্তাহ খানেক বিরতি দিয়ে দীর্ঘদিন খান। হৃদপিন্ড, স্নায়ু এবং মস্তিষ্কের উপর ইহার প্রশান্তিকারক ক্রিয়া বিদ্যমান। তাছাড়া যেহেতু এটি একটি ভিটামিন জাতীয় ঔষধ, তাই ইহার কোন ক্ষতিকর সাইড- ইফেক্ট নাই বললেই চলে। Coffea Cruda : মানসিক উত্তেজনা,
উৎকণ্ঠা, দুঃশ্চিন্তা থেকে অনিদ্রা দেখা দিলে তাতে কফিয়া প্রযোজ্য। সুসংবাদ শুনে, আনন্দের আতিষয্যে, শিশুদের দাঁত ওঠার বয়সে বা রাত জাগার কারণে অনিদ্রা হলে তাতে কফিয়ার কথা ভাবতে হবে। মহিলাদের সন্তান প্রসব পরবর্তী সময়ের অনিদ্রায় কফিয়া ভালো কাজ করে। খুবই
সেনসেটিভ রোগীদের ক্ষেত্রে কফিয়া প্রযোজ্য যারা আওয়াজ সহ্য করতে পারে না, গন্ধ সহ্য করতে পারে না, স্পর্শ সহ্য করতে পারে না ইত্যাদি ইত্যাদি। Ambra Grisea : সাধারণত চাকুরি বা ব্যবসা সংক্রান্ত দুঃশ্চিন্তার কারণে নিদ্রাহীনতা হলে তাতে এমব্রাগ্লিসিয়া প্রযোজ্য।
সারাদিন পরিশ্রম করে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে কিন্তু যখনই বালিশে মাথা রাখে, সাথে সাথেই ঘুম চলে যায়। এই ঔষধের একটি অদ্ভুত লক্ষণ হলো এরা অপরিচিত কেউ সামনে বা আশেপাশে থাকলে, পায়খানা করতে পারে না। Hyoscyamus Niger : মাত্রাতিরিক্ত মাথা
খাটুনির কাজ (brainwork) করার কারণে অনিদ্রা দেখা দিলে তাতে হায়োসাইয়েমাস খেয়ে উপকার পাবেন। মাথার মধ্যে জোয়ারের পানির মতো ফালতু চিন্তার স্রোত বইতে থাকে। যদি শিশুরা ঘুমের মধ্যে চীকার করে ওঠে, কাঁপতে থাকে : তবে তাতে হায়োসায়েমাস প্রযোজ্য।
Sulphur : সকাল ১১টার দিকে ভীষণ খিদে পাওয়া, শরীর গরম লাগা, মাথা গরম কিন্তু পা ঠান্ডা, মাথার তালু- পায়ের তালুতে জ্বালাপোড়া ইত্যাদি লক্ষণ পাওয়া গেলে নিদ্রাহীনতা রোগেও সালফার প্রয়োগ করে দারুণ ফল পাবেন। Belladonna : যদি মুখমন্ডল বা মাথা
গরম বা লাল হয়ে থাকে, মাথা ব্যথার থাকে, শরীরে জ্বালা-পোড়াভাব থাকে ইত্যাদি কারণে নিদ্রাহীনতা দেখা দেয়, তবে তাতে বেলেডোনা প্রযোজ্য। Chamomilla : শরীরের কোথাও মারাত্মক ব্যথার কারণে ঘুমাতে না পারলে, সেক্ষেত্রে ক্যামোমিলা প্রয়োগ করতে হবে।
যারা অর্থহীন আজেবাজে স্বপ্নের কারণে শান্তিতে ঘুমাতে পারে না, ঘুমের ভেতরে ছটফট করতে থাকে, দুবর্ল- নার্ভাস মহিলা, শরীর গরম, প্রচুর পিপাসা ইত্যাদি লক্ষণ থাকলে ক্যামোমিলা উপকার দিবে। Arsenic Album : মাত্রাতিরিক্ত অস্থিরতা, এক মুহূর্তও এক পজিশনে
স্থির থাকতে পারে না, লক্ষণ থাকলে তাতে আর্সেনিক খেতে হবে। রাতে একবার ঘুম ভাঙলে আর ঘুম আসে না। Gelsemium : সাধারণত যারা অতিরিক্ত মানসিক পরিশ্রম করেন অথবা বিষন্নতায় ভোগেন, তাদের অনিদ্রা দূর করতে ব্যবহৃত হয় । Ignatia Amara :
সাধারণত শোক-দুঃখ-বিহ-বিচ্ছেদ ইত্যাদি কারণে ঘুম না আসলে তাতে ইগ্নেশিয়া প্রযোজ্য। এদের ঘুম এত পাতলা হয় যে, তারা ঘুমের মধ্যে চারপাশের সবকিছুই শুনতে পায়। Magnesium Carbonica : সাধারণত পেটের কোন অস্বস্তি, ভীষণ শীতকাতর-জামাকাপড়
খুলতে চান না, পেটে গ্যাসের উৎপাত, আক্কেল দাঁত ওঠা, সারারাত ঘুমিয়েও ফ্রেস লাগে না ব্রং ঘুম থেকে ওঠার পরে খুবই টায়ার্ড লাগে-মনে হয় সারারাত কুস্তি খেলেছেন, আগুন-ভাকাত-ঝগড়া-মরা মানুষ ইত্যাদি স্বপ্ন দেখে ইত্যাদি লক্ষণে ম্যাগ কার্ব খেতে পারেন।
Cocculus Indicus : সাধারণত ভীতু, নার্ভাস, অত্যধিক পড়াশোনা করে এমন লোকদের ক্ষেত্রে কুকুলাস প্রয়োগ করতে হয়। রাত জেগে কাজ করার কারণে যদি অনিদ্রা দেখা দেয়, তবে অবশ্যই ককুলাস খাবেন। Cannabis Indica : ক্যানাবিস ইন্ডিকা সাধারণত
দীর্ঘদিনের পুরনো এবং দুরারোগ্য অনিদ্রা রোগে প্রযোজ্য। যাদের একেক দিন একেক টাইমে ঘুম আসে, দিনে ঘুম আসে প্রচুর, রাতের ঘুমে কোন আরাম পাওয়া যায় না, রাতে গরম লাগে যেন কেউ তার গায়ে গরম পানি ঢালতেছে ইত্যাদি লক্ষণে ক্যানাবিস খেতে পারেন। যেহেতু এই
ঔষধটি গাঁজা থেকে তৈরী করা হয়, তাই বলা যায় গাঁজার নেশা করার কারণে যদি কারো অনিদ্রা দেখা দেয়, তারা এটি খেয়ে উপকৃত হবেন।